রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

রে ব্র্যাডবেরীর উদ্ধৃতি, বই পড়ার অভ্যাস ও আমার চিন্তার খোরাক

ফেসবুকে আজ এক নেটাতো বন্ধু ( যার লেখার আমি একজন বড় ভক্তও) দেখি অন্যতম প্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক রে ব্র্যাডবেরীর একটা কথা উদ্ধৃতি দিয়েছে। কথাটা হলো

You don t have to burn books to destroy a culture. Just get people to stop reading them
পড়ে কিছুক্ষণ থমকে থাকলাম। আমার ভেতরে ভীষন রকম নাড়া দিয়ে গেলো কথাটা। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথাটা তো যারপরনাই সত্য! এখন পড়ার বইয়ের পাশাপাশি কতজন পড়ছেন গল্পের বই? বই নিত্যসঙ্গী কয়জনের? একুশে বইমেলা বাদ দিলে সারা বছর জুড়ে কতজন বই কিনছেন? সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, পরিসংখ্যান করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি সংখ্যাটা খুব বেশী নয়। আরো ভয়ানক কথা হচ্ছে - এই সংখ্যাটা সম্ভবত দিন দিন কমছে!

কেন বলছি? বলছি কয়েকটা অভিজ্ঞতা আর পরিদর্শন থেকে। বর্তমানে ফেসবুক ও অন্তর্জালের যুগে অনেক বেশী বই পড়ুয়ার সাথে পরিচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বইয়ের রিভিউও পাচ্ছি অনেক বেশী। আর ই-বুকের তো কথাই নেই এখন বাংলা ই-বুকও পাচ্ছি অজস্র। তারপরও কেন আমার এই হতাশাবাদী কথা? আমি তো আশাবাদীই হতে চাই, কিন্তু আশেপাশের নমুনা দেখে আশা করার আশাটাও যে করতে পারছি না!

বছর দশেক আগেকার কথা। আমি মাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলের বাস ধরে ফিরে যাই আমার পদ্মা পাড়ের শহরে ছুটির দুটো দিন ওখানে কাটিয়ে সংগ্রহ করে আনি পরের পাঁচ দিনের জীবন সংগ্রামের রসদ। অবধারিত ভাবে অফিস থেকে বের হয়ে আগে একটা-দুটো বই কিনি, ফেরার পথ কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যায় টের পাই না। বাড়ি ফেরার টানের সাথে বইয়েরও একটা প্রধান ভূমিকা থাকে এতে।

অফিস থেকে বাস স্ট্যান্ড এই পথের মধ্যেই দুই তিনটা বইয়ের দোকান পড়ত, বই কিনতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি তাই। বিশেষ করে পথের মাঝে কিছুটা দূরে দূরে দুটো বাস স্টপে ছিল দুটো বইয়ের দোকান যারা আমার বিশেষ প্রিয় ছিল। আর আমার নিজের ছোট্ট শহরটাতে তো এখানে ওখানে বইয়ের দোকান ছিল সমবায় সুপার মার্কেট নামে একটা মার্কেটই ছিল বইয়ের দোকানে ভর্তি।

এরপর চাকরীর সুবাদে ঘোরাঘুরি দেশের উত্তর প্রান্তের শহরগুলোতে। ওখানে অবস্থানের দিনগুলিতে বই কিনতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। একটা কারণ চাকরীর ধরণ সময় খুব বেশী পাওয়া যেত না। আরেকটা কারণ নতুন শহরের আনাচে কানাচে সেভাবে হয়তো খোঁজ নিতে পারি নি। তাই বই কিনতে প্রায়ই পুরো শহর পাড়ি দিয়ে অন্যপ্রান্তে যেতে হতো। যখন বইয়ের খোঁজে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা যেতাম, মনের ভেতরে একটা কষ্ট গুমরে উঠতো রাস্তার পাশে একটু দূর পর পর মোবাইলের দোকান, ফাস্ট ফুডের দোকান দেখে। রাজধানী থেকে এত দূরেও ব্যাঙের ছাতার মত ফাস্ট ফুড বা মোবাইলের এটা ওটার দোকান গজিয়ে উঠতে তো কোন অসুবিধে হয়নি, কয়েকটা বইয়ের দোকান হতে কী ক্ষতি ছিল? নিজেকে স্বান্ত্বনা দিতাম - ছোট শহর তো, তার উপরে দেশের দরিদ্রতম এলাকার একটা- এখানে বইয়ের দোকান সেভাবে এখনি তো হবে না, তবে হবে নিশ্চয়ই, হবে অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে।

এরপর আবার বছর কয়েকের জন্য ফিরে এলাম আমার আশৈশব প্রিয় শহরে। কিন্তু মন গহনে বয়ে চলা দুঃখের সেই চোরাস্রোত থামলো না! এত্তগুলো বইয়ের দোকান ছিল, এখন আছে মাত্র গুটি কয়েক! কোথায় সমবায় মার্কেটের সারি সারি দোকান গুলো? সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে সরে গেছে, জায়গা ছেড়ে দিয়ে গেছে স্টেশনারী আর জেনারেল স্টোরকে! প্যাপিরাস, সূচীপত্র আর গ্রন্থমেলার জায়গা নিয়েছে মেসার্স হালিম ট্রেডার্স আর জেনারেল পেপার স্টোর। একপাশে তাও একটা বই বাজার আছে, আছে ঐতিহ্যবাহী আলিগড় লাইব্রেরীও, কিন্তু তারা স্নাতক-স্নাতকত্তোর শ্রেণির বই ছাড়া অন্য কোন বই রাখে না। এদের পাশে টিমটিম করে হাতে গোনা গুটিকয় দোকান এখনো আছে, কিন্তু তারা মনে হচ্ছে ডাইনোসরের প্রজাতি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই তাদের হিমশিম খাবার অবস্থা! অথচ মোবাইলের যন্ত্রপাতি আর ফাস্ট ফুডের দোকানের রমরমা অবস্থা এখানেও। রীতিমতো দুই-তিনটা আলাদা বাজারই বসে গেছে এদের জন্য!
এরপর আমার পুনরাগমন রাজধানী শহরে। থানা গাড়লাম শহরের উত্তরপ্রান্তের একটা এলাকায়। হয়তো রাজধানীর সাথে খুব একটা চেনা জানা নেই বলেই আশে পাশে কোথায় বইয়ের দোকান আছে খুঁজে পাই না, যাও দুয়েকটা পাই, তারা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের বই আর খুব বেশী হলে স্নাতক শ্রেনির কিছু বই রাখে, তাও জনপ্রিয় কিছু বিষয় যেমন কম্পিউটার, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসায় প্রশাসন ইত্যাদির। অগত্যা আবার সেই নীলক্ষেতের দ্বারস্থ হতে হলো।
কিন্তু তিলোত্তমা ঢাকা নগরীর এমাথা থেকে ওমাথা যাওয়ার চেয়ে
বড় বালাই আর নাই। তাই বাধ্য হয়ে মাসে এক-দুবার যাই, একেবার একগাদা করে বই কিনে ফিরে আসি। আর পথের ধারে মোবাইলের ছোট ছোট দোকানগুলো দেখে কষ্টের চোরাস্রোতটা তিরতির করে কাঁপন তোলে বুকের মাঝে।

আসা যাওয়ার পথের ধার থেকে খুব বেশী দূরে নয় আমার বছর দশেক আগেকার সেই সাপ্তাহিক পথটা। একদিন গেছিলাম পুরাতন সেই দুই বইয়ের দোকানের খোঁজে। নিয়মিত বই কেনার সুবাদে কয়েকজনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল, তাদের সাথে আবার দেখা করার একটা সুপ্ত বাসনাও ছিল মনের মাঝে। কিন্তু ওখানে গিয়ে আবারও হোঁচট খেলাম বইয়ের দোকানদুটো উঠে গেছে! আর সেখানে বসেছে মোবাইলের একটা দোকান আর একটা কনফেকশনারী!


বইয়ের দোকানের এভাবে ক্রমশ লোপপ্রাপ্তির পেছনে কারণ কি এটাই যে আমরা ক্রমশ বই বিমুখ হয়ে পড়ছি? ঢাকায় চলাফেরার সময়ে বাসে কিংবা বিভিন্ন সময়ে চায়ের দোকানে প্রচুর কিশোর-তরুনকে দেখি। মোবাইলে কথা বলার পাশাপাশি এরা গেমস বা ফেসবুক ইত্যাদি ব্যবহার করে। শুধু কৌতুহল বশত প্রায় জনা পনেরো জনকে প্রশ্ন করে জেনেছি এরা কেউ মোবাইলকে ই-বুক রিডার হিসেবে ব্যবহার করে না। বেশীরভাগ তো কিনডলের নামই শোনেনি, যদিও রেইল রাশ বা টেম্পল রান পরিচিত সবার কাছেই। আমার এই ছোট্ট কৌতুহলী প্রশ্ন অবশ্যই বর্তমানকে কোন ক্রমেই সর্বোতভাবে প্রতিফলিত করে না। কিন্তু আমার নিজের কাছেই এই প্রশ্নটা বার বার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা আগেও খুব একটা বইপ্রেমী বা পড়ুয়া জাতি ছিলাম না। যেটুকু ছিলাম, এখন কি তাও হারিয়ে যেতে বসেছে? আজ রে ব্র্যাডবেরীর কথাটা পড়ার পরে মনে হচ্ছে পাকিস্তানীরা ভয়াল ছোবল হেনে আমাদের যে জায়গাটায় চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিল কিন্তু একেবারে ধ্বংস করতে পারেনি, আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেই জায়গাটাকে ধ্বংস করার উৎসবে মেতেছি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন