রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

সেবা প্রকাশনীর সেকাল ও একাল – একজন পাঠকের চোখে

আমি জানিনা সেবা প্রকাশনীর ইদানীং কী হয়েছে – বর্তমানে অনুবাদের মান তলানীতে এসে ঠেকেছে। গত মাস পর্যন্ত (সী হক, অনুবাদ সম্ভবত সায়েম সোলায়মান) প্রকাশিত সেবার সবকয়টি অনুবাদ আমি পড়েছি। কিন্ত বিগত দুই/তিন বছরের অনুবাদগুলো আমাকে সন্তষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি শেষ ভালো অনুবাদ (সেবা প্রকাশনীর) পড়েছি বোধহয় “মন্টেজুমার মেয়ে”। এর পরের কোন অনুবাদই মনে দাগ কাটতে পারেনি। ছেলেবেলায় পড়া তিন মাস্কেটিয়ার, কালো তীর, রবিনহুড, আইভানহো কিংবা সাগরতলে বা আশি দিনে বিশ্বভ্রমণের সেই আবেদন এখনকার কোন অনুবাদে পাই না। এটা কি বড় হয়ে যাওয়ার ফল? না মনে হয়, কারণ মন্টেজুমার মেয়ে (অনুবাদ কাজী আনোয়ার হোসেন) তো আগের মতই লেগেছে। একটা কারণ কি অনুবাদক পরিবর্তন হয়ে যাওয়া? হতে পারে, কারণ কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, শেখ আবদুল হাকিম, রওশন জামিল, শওকত হোসেন কিংবা নিয়াজ মোর্শেদের সেই জাদুকরী ভাষা আসলেই এখনকার সায়েম সোলায়মান, টিপু কিবরিয়া কিংবা কাজী মায়মূর হোসেনের লেখায় পাই না, পাই না সেবার প্রতিষ্ঠা করা সহজিয়া মনকাড়া সেই ভাষাশৈলী।
শুধু অনুবাদই নয়, এ কথা প্রযোজ্য কম-বেশী সেবার সব বইয়ের ক্ষেত্রেই। সাম্প্রতিককালের মাসুদ রানা পড়ে আগের সেই অনুভূতিগুলি ফিরে আসে না। অগ্নিপুরুষ পড়ে চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা দুই ফোঁটা অশ্রু, কিংবা রডরিকের সাথে গলামিলিয়ে “আই লাভ ইউ, ম্যান” বলতে গিয়ে আবিষ্কার করা গলা বুঁজে গেছে অথবা দ্বারোকার কামানে বোমা বাঁধার পর টের পাওয়া যে এতক্ষন দম আটকে রেখেছিলাম – কই, নতুন বইগুলোর একটারও ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনা কেন?
আলেয়ার পিছেতে যে এরফান জেসাপের সাথে পরিচয়, ডেথ সিটি বা আবার এরফানের পাতায় পাতায় যার দুর্ধর্ষতার নিয়ত প্রমাণ, সেই এরফান যেন কোথায় হারিয়ে গেল – অ্যারিজোনায় এরফান বা পরের বইগুলিতে তাকে আর সেইভাবে পেলাম না। টান টান কাহিনি আর পাতায় পাতায় উত্তেজনায় ভরা সেই ওয়েস্টার্নের কোন টানই যেন পাই না এখন। আগেকার হুয়ান কর্টেজ ওরফে সাবাডিয়া, সাডেন শেভলিন, ড্যান ও’হারা প্রভৃতি চরিত্রদের পাশে এখনকার চরিত্রগুলো বড়ই পানসে।
সবচেয়ে হাস্যকর পরিবর্তন বোধহয় হয়েছে তিন গোয়েন্দায়। সাইকেল চালিয়ে বেড়ানো দুরন্ত কৈশোরের প্রতীক সেই তিন গোয়েন্দা নাকি এখন ভূত ঠেকাতে আর ভিন-গ্রহবাসীদের নিয়ে ব্যস্ত!
আর উপন্যাস বা গল্প সংকলনের কথা তো বলাই বাহুল্য। আত্মহত্যা, বন্দিনী, হলো না রত্না, বিদেশযাত্রা, পঞ্চরোমাঞ্চ, ছয়রোমাঞ্চ, ছায়া অরণ্য, অষ্ট আতংকের মত বই তো দূরের কথা, গুন্ডা বা শোধ নেবে? এর মতও বই পেলাম না বহুদিন। বলতে ইচ্ছে করে – মাথাই নেই তার আবার মাথাব্যথা!
প্রায় তিন দশক ধরে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা এবং জীবন, ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সেবা প্রকাশনীর বর্তমান হালে আমি বড়ই মর্মাহত।
-১৮/০৭/২০১২ 

শৈশব ও কৈশোরের সেই দিনগুলি বনাম আমার ছেলে

ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠ ঘাট পেরিয়ে অজানা এলাকায় হাজির হওয়া বা একদল ছেলে মিলে সময় পেলেই পদ্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া বা উজানে যাওয়া বালিবাহী নৌকা ধরে কিছুদুর গিয়ে আবার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে আসা কিংবা শীতের সকালে গাছ থেকে সদ্য পাড়া খেজুরের রস খাওয়ার জন্য গ্লাস হাতে ভাইবোনদের সাথে লাইন দেয়া অথবা ঝড়ের মধ্যে মায়ের বারণ না শুনে আম কুড়োতে দৌড় – যাওয়া বা আসার পথে পাড়ার ছেলেরা মিলে দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা কখনো কখনো কাদার মধ্যে ফুটবল খেলা যেখানে খেলার চেয়ে গড়াগড়ি খাওয়াটাই বেশী হতো – ছেলেবেলার এই স্মৃতিগুলো এখনও মনের মনিকোঠায় এতই উজ্বল অক্ষরে লেখা যে, যে কোন মুহূর্তে চাইলেই এদের আদ্যোপান্ত জ্বলজ্বল করে ওঠে। মনে হয় এইতো সেদিন বন্ধুদের সাথে বাজিধরে ক্যান্টনমেন্টের গাছের আম চুরি করতে গেছি, এক আর্মি দেখে ফেলায় এক দৌড়ে প্রাচীর পার হয়ে পাশের পুকুরে লাফ দিয়ে পড়েছি (ভাগ্যিশ সেই ব্যাটাও আমার পিছু পিছু প্রাচীর টপকাতে আসেনি) কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারীর ভোরে সবাই মিলে আশে পাশের বাড়ী থেকে (যাদের ফুলগাছ ছিল) ফুল চেয়ে নিয়ে শহীদ মিনারে অর্পণ করে এসেছি – এরকম আরো কত স্মৃতি!!
মনে পড়ে শৈশব বা কৈশোরে স্কুলের গরমের ছুটির দিন গুলোতে বাড়িতে থাকতাম শুধু খাওয়ার সময়ে। মা-বাবারও ছেলেকে নিয়ে অত চিন্তা ছিলনা, সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরলেই চলত। আর একটু বড় হওয়ার পর তো সারাদিন মেতে থাকতাম ফুটবল নয়তো ক্রিকেট খেলা নিয়ে। সন্ধ্যার পরে অবশ্য পড়তে বসতে হতো – তাও রাত ন’টা পর্যন্ত।
স্মৃতির ডানায় ভর করে সেই স্বপ্নময় দিন গুলোয় ফিরে গেলে এই সব সোনালী ছবিগুলোই ভাসে মনের আয়নায়। আমার ছেলেকে (বয়স সাত বছর) যখন আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাই, ওর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখি। ওকে লুকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি – কারণ ইচ্ছে করলেও এরকম শৈশব ওকে দিতে পারছি না! দেব কি, সারাদিন তো ওকে বাসাতেই আটকে রাখি। খেলতে দেবো, মাঠ কোথায় এই ইঁট-কাঠ-পাথরে ঢাকা ঢাকা শহরে? যাও বা আছে, নিরাপত্তাহীনতায় ওকে একা পাঠানোর কথা ভাবতেও পারি না। আমি যে নিয়ে যাবো- অফিস থেকে বের হয়ে যানজট পার হয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বাজে রাত আটটা!! তাই বেচারা মাঠের অভাবে ব্যালকনিতে দৌড়াদৌড়ি করে। কখনো কখনো কোন পার্কে বা খোলা জায়গায় নিয়ে গেলে ওর আর আনন্দের সীমা থাকেনা! আর সেটা দেখে আমার ভেতরের কষ্টটা বাড়ে আরো – ওকে তো প্রতিদিন এই সুযোগটা দিতে পারছি না!
আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটা অনেকটা “ফার্মের মুরগীর” মত বড় হচ্ছে। প্রতিদিন দেখি, আর অক্ষম একটা আক্রোশে নিজেই গুমরে মরি – এ রকম একটা শৈশব কি ওর পাওনা ছিল?
-১৯/০৭/২০১২