রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

গ্রীক পুরাণের উপাখ্যান - ইউরোপা অপহরণ

ভূমধ্যসাগরের তীরে সুজলা সুফলা এক শান্তিপূর্ণ রাজ্য ফিনিশিয়া। সেখানে রাজত্ব করেন রাজা এজিনর। রাজা এজিনর আর রাণী টেলেফাসার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। দুই ছেলে ক্যাডামাস আর সিলিক্স (যার নামানুসারে পরে সিসিলিয়া দ্বীপের নাম রাখা হয়েছে)। আর একমাত্র মেয়ে রাজকন্যা ইউরোপা। (কারো কারো মতে ইউরোপা ছিল রাজা ফিনিক্সের কন্যা, যে ফিনিক্সের নামানুসারে ফিনিশিয়া রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল)। তো যাই হোক, এই রাজকন্যা ইউরোপা ছিল অসামান্যা রূপসী। তার রূপ দেখলে সবাই থ হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুখে আর কথা সরে না। 

এক রাতে স্বপ্ন দেখে ইউরোপার ঘুম ভেঙে গেল। সে স্বপ্নে দেখে দুই মহাদেশ দুই নারীর বেশ ধরে এসে তার উপরে নিজেদের দাবী জানাচ্ছে। একজন হলো এশিয়া মহাদেশ। সে বলে যেহেতু এশিয়ায় জন্ম, তাই ইউরোপার উপরে তার দাবীই যথার্থ। কিন্তু অপর মহাদেশ, যার এখনো কোন নাম নেই, সরবে ঘোষনা করছে জন্মস্থান মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না কারণ দেবরাজ জিউস তার কাছে ইউরোপাকে উপহার দেবেন।

এই রকম স্বপ্নের মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে না পেরে ইউরোপা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। তারপর ভোর হয়ে এসেছে দেখে সখীদেরকে ডেকে ফুল তুলতে গেলো। সাগর পাড়ে রাজা এজিনরের রাজপ্রাসাদ। সুনীল জলরাশি এসে লুটিয়ে পড়ছে বালুকাবেলায়। আর তার পাশেই বিশাল এক বাগান। কত রকমের ফুল সেখানে। গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে আছে রকমারী সব ফুল, মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে অল্প অল্প। আর কী তাদের বাহার। বোধহয় তারই আকর্ষণে ছুটে এসেছে অলির দল, গুঞ্জন তুলেছে এখানে ওখানে। এমন চমৎকার রোদ ঝলমলে ফুটফুটে দিনে বাগানের রাশি রাশি ফুলের মাঝে কোথায় উড়ে গেলো ইউরোপার রাতের স্বপ্ন! ইউরোপা ব্যস্ত হয়ে পড়লো সখীদের সাথে খেলায় আর ফুল তোলায়।

এদিকে হয়েছে কী দেবরাজ জিউস তাঁর অলিম্পাসের প্রাসাদে বসেছিলেন। হঠাৎই তাঁর নজর পড়লো ফিনিশিয়ার সাগর তীরে ইউরোপাদের উচ্ছল দলটির উপরে। ইউরোপার নজরকাড়া সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেলেন তিনি। আর ঠিক ওই সময়েই প্রেমের দেবতা এরস এসে হাজির হলেন জিউসের কাছে। জিউসকে মুগ্ধ নয়নে ইউরোপার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর তাঁর হাতের ধনুক থেকে ছুঁড়লেন একটি পুষ্পশর সোজা জিউসের দিকে। ব্যস, আর যায় কোথা, মুহূর্তেই ইউরোপার প্রেমে পড়ে গেলেন দেবরাজ। এমনিতেই ইউরোপার অনিন্দ্যসুন্দর রূপ আর অপরূপ দেহবল্লরী মুনি ঋষিদেরও ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়, তার উপরে প্রেমের দেবতার শর! দেখতে না দেখতেই জিউস প্রেমাবেগে পাগলপারা হয়ে উঠলেন।

জিউস পত্নী হেরা তখন ব্যস্ত ছিলেন অন্যদিকে। এই সুযোগে জিউস নিজেকে রূপান্তরিত করলেন ধবধবে সাদা একটা ষাঁড়ে। তারপর এসে নামলেন সাগরপাড়ের ফুলবাগানে, যেখানে ইউরোপা ব্যস্ত বান্ধবীদের নিয়ে ফুল তোলায়।
ইউরোপা আর তার বান্ধবীরা তো ষাঁড়টিকে দেখে রীতিমত অবাক! এত সুন্দর যে কোন প্রাণী হতে পারে, তা তাদের ধারণারও বাইরে ছিল। কী ফুটফুটে গায়ের রঙ! ঠিক যেন শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে জ্যোছনা! আর বাগানের সব ফুলের গন্ধ ম্লান হয়ে যায় এর সৌরভে। সুরেলা গলায় মৃদু শব্দ করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ষাঁড়টি। শব্দ তো নয়, মনে হচ্ছে যেন মৃদুমন্দ লয়ে বাজনা বাজছে কোথাও! ষাঁড়টিকে সবাই মিলে ঘিরে ধরলো।

আশ্চর্য! ষাঁড়টি ভয়ও পাচ্ছে না ইউরোপাদেরকে।বরং গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে আরামে সুরেলা শব্দ করছে। আর ইউরোপা যখন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তখন তো ষাঁড়টি রীতিমতো প্রায় একটা গানই গেয়ে ফেললো!

ব্যাপারস্যাপার দেখে ইউরোপার তো খুশী আর ধরে না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে, আর তার তৈরী করা ফুলের মালাগুলো জড়িয়ে দিলো ষাঁড়ের গলায় আর শিঙে। ষাঁড়ও যেন খুশি ইউরোপার আদর পেয়ে। আস্তে করে সামনের পা জোড়া মুড়ে পিঠ নিচু করে দাঁড়ালো। আনন্দে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফ দিয়ে ষাঁড়ের পিঠে উঠে পড়লো ইউরোপা।

যেই না ইউরোপা তার পিঠে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে পিঠ সোজা করে ফেললো সেই ষাঁড়, আর তীর বেগে ছুটলো সাগরের দিকে। হায় হায় করতে করতে ইউরোপার সখীরা ছুটলো ষাঁড়ের পিছু পিছু। কিন্তু তারা তো সাধারণ মানবী। হোক না উচ্চবংশীয়, মানুষ তো। পারবে কেন ষাঁড়রূপী দেবরাজের সাথে? দেখতে না দেখতে ষাঁড়টি ইউরোপাকে পিঠে নিয়ে নেমে পড়লো সমুদ্রে। আর সখীরা সাগরের তীরে বসে আকুল নয়নে কাঁদতে থাকলো।

ষাঁড়ের পিঠে বসে ইউরোপা দেখছে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় ফিনিশিয়ার তটরেখা তাকে নিয়ে ষাঁড়টি দ্রুতবেগে সাঁতরে চলেছে গভীর থেকে আরো গভীর সমুদ্রে। আর তাদের আশেপাশে রীতিমতো মিছিল তৈরী করে ফেলেছে বিভিন্ন জীব জন্তু আর দেবতার দল। ডলফিনের পিঠে চেপে এসেছে নারিয়ার্ডসরা, চক্কর দিচ্ছে তাদেরকে ঘিরে। সমুদ্রদেব পসাইডনের ছেলে ট্রাইটনকে দেখা যাচ্ছে মহানন্দে তার শঙ্খ বাজাচ্ছে। আরে ওইতো, সমুদ্র দেবতা পসাইডন নিজেও আছেন দেখা যাচ্ছে!

ইউরোপার আর বুঝতে বাকি নেই যে এই ষাঁড়টি একটি ছদ্মবেশী দেবতা। সে করুণ সুরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো দেবতার কাছে যেন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়, তাকে তার দেশে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হয়। জিউস তখন ইউরোপাকে জানালেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। ইউরোপার প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রণয়ের কথা সবিস্তারে বললেন।

এরপর জিউস ইউরোপাকে নিয়ে এলেন ক্রীট দ্বীপে। সেই ক্রীট দ্বীপ যেখানে জিউস নিজে জন্মেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। ডিক্টে গুহা যেখানে জিউস জন্মগ্রহণ করেন, রূপ নেয় জিউস আর ইউরোপার প্রেমকুঞ্জে। এখানেই ইউরোপার গর্ভে জিউসের তিন পুত্র সন্তান হয়। এদের মধ্যে মিনোস পরে ক্রীট দ্বীপের রাজা হয়েছিলেন এবং বিখ্যাত মিনোয়ান বংশের সূচনা করেছিলেন।

জিউস ইউরোপার প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ ইউরোপাকে তিনটি উপহার দেন। প্রথম উপহার ছিল টালোস নামে ব্রোঞ্জের তৈরী একটি সৈনিক, যে ক্রীট দ্বীপের পাহারাদার ছিল। দ্বিতীয় উপহারটি ছিল একটি অদ্ভুত সুন্দর ও দক্ষ শিকারী কুকুর যার নাম লাইয়েল্যাপস। আর তৃতীয় ও শেষ উপহারটি ছিল একটি বর্শা যা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়না।
কথিত আছে যে ক্রীট দ্বীপের গোরটিন ছিল ইউরোপা আর জিউসের প্রথম মিলনস্থল। তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন একটা সাধারণ গাছের নীচে। পরে জিউসের আশীর্বাদে এই সাধারণ গাছটি পরিনত হয় একটি চির-হরিৎ বৃক্ষে। আর যে ষাঁড়ের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন জিউস, তাকে অমর করে রাখা হয় তারকামন্ডলীতে স্থান দিয়ে। বৃষ রাশিই হচ্ছে সেই তারকামন্ডল।

ইউরোপার অপহরণের কাহিনি আজো লোকের মুখে মুখে ফেরে। তাইতো ইউরোপা অপহরণের এই কাহিনি নিয়ে চিত্রকর্মের পাশাপাশি ২ ইউরো মানের গ্রিক মুদ্রায় খোদিত হয় ষাঁড়রূপী জিউস কর্তৃক ইউরোপা অপহরণের দৃশ্য। আর ইউরোপ মহাদেশের নামকরণ করা হয় ইউরোপা থেকেই যেমনটি ইউরোপার স্বপ্নে ছিলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন