প্রিয়
ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের এক ছড়া সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রিয় ছড়াকারদের নিয়ে
বলেছিলেন “আমার প্রিয় দুই সুকুমার, বড়ুয়া ও রায়/ তাদেরই নাম আগে লিখি
প্রিয়র তালিকায়”। দুই সুকুমার আমারও খুব প্রিয়। বিশেষত সুকুমার রায় যে সবচেয়ে
প্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার নেয়া নিকটাই বোধহয় এর সবচেয়ে বড় নমুনা।
আজকের লেখাটা সুকুমার রায়কে নিয়েই, তবে লেখাটা হয়ত হতো না যদি না আজকের ঘটনাটা
ঘটতো। ঘটনাটা যথাসময়ে বলবো, তার আগে সংক্ষিপ্ত পূর্বকথাটা বলে নিই।
সুকুমার রায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার আব্বু। আমি
বোধহয় তখন ক্লাস টু-এ পড়ি। নতুন ক্লাসের নতুন বই হাতে পেয়ে যথারীতি উল্টেপাল্টে
দেখছি আর নতুন বইয়ের গন্ধ নিচ্ছি (কী যে ভালো লাগতো নতুন বইয়ের গন্ধ! এখনও
লাগে)। বাংলা বইটা হাতে নিয়ে দেখছি, আব্বু বললেন সুকুমার রায়ের ছড়াটা পড়ো। সেই
প্রথম পড়া – “দাদা গো দেখেছি ভেবে অনেকদূর---”।
যদিও এর পরের লাইনেই হোঁচট খেলাম আগের লাইনের সাথে কোন মিল নেই দেখে (মিল ছাড়াও
কবিতা হয় এই ধারণাটা তখনো হয়নি)। কিন্তু তারপরও প্রবল এক আকর্ষনে টেনে নিয়ে
গেলো ছড়াটা। পড়তে থাকলাম –“এই দুনিয়ায় সকল ভালো/আসল ভালো নকল ভালো---”
অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে ছড়াটা ভালোলাগার এক আবেশময় দুনিয়ায় দুলিয়ে চলছিল
আমাকে। তারপর এলো সেই বিশেষ মুহূর্ত- চমকে উঠলাম শেষ লাইনটা পড়ে –
“পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়”! এইভাবে যে প্রথম
লাইনের সাথে শেষ লাইনটা মিলিয়ে দেয়া যায়, শৈশবের শুরুতেই মুগ্ধ বিস্ময়ে তা
আবিস্কার করা সুকুমারের হাত ধরে। ছড়াটা পড়তে এতটাই ভালো লেগেছিল যে ঐ রাতেই
ছড়াটা আমার মুখস্ত হয়ে গেছিল। এর পরের কটা দিন বাড়ির লোক তো বাড়ির লোক, গোটা
পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করে ছেড়েছিলাম যখন তখন ছড়াটা শুনিয়ে।
সেই শুরু। তারপর যেখানেই পাই, সুকুমার গিলি। রকম সকম দেখে কয়েক
বছর পর আব্বু আমাকে সুকুমার সমগ্র কিনে দিলেন। আমার তো মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে
পেলাম!! এর পরের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পাঠকের ধৈর্য্যের আর পরীক্ষা নেবো না –
আমার মনে হয় সুকুমার নিয়ে বা সুকুমার সমগ্র নিয়ে সবার অভিজ্ঞতাই মোটামুটি একই
রকম। শুধু এইটুকু বলি – কালের গর্ভে আমার অনেক বই ই “মার্ক টোয়েনীয়
কায়দায়” মালিকানা বদল করেছে, কিন্তু ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ে পাওয়া
সুকুমার সমগ্র এখনও সগর্বে আমার বইয়ের তাকের উপরের অংশ দখল করে রেখেছে।
এর পরের ঘটনা প্রায় দেড় যুগ পরের। আমার বড় ছেলের বয়স তখন দেড়
বছর। রাতের বেলা ঘুমোতে চায় না, ট্যাঁ ট্যাঁ করে সারা পাড়া জাগিয়ে রাখে। আমি
ওকে বুকে চেপে এ ঘর ও ঘর করি আর গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করি। সময় লাগে
অনেক। পরিচিত ঘুম পাড়ানি গানগুলোও এত ছোট যে বারবার একই গান গাইতে বিরক্ত লাগে।
অগত্যা বড় বড় ছড়াগুলো ওকে গানের সুরে গেয়ে শোনানো শুরু করলাম। এখানেও দেখি
সুকুমারের জয়জয়কার। “দুই বিঘা জমি”, “দেবতার গ্রাস” কিংবা “বিদ্রোহী”র চেয়ে খাই খাই সুর করে গাওয়া অনেক সহজ আর আকর্ষনীয়!! সুতরাং “ধন
ধান্য পুষ্প ভরা” আর “খাই খাই করো কেন” হয়ে উঠলো জীশানের ঘুম
পাড়ানি গান। ফলাফল হলো ভারি মজার – একটু বড় হয়ে দেখি সে
আপন মনে মাঝে মাঝে গাচ্ছে “কাই কাই কলো কেন এতো বোতো আহালে”।
ব্যস, আরেকটা মজা শুরু হয়ে গেলো। ওর আধো আধো বোলে “কাই
কাই” পারিবারিক বিনোদনে পরিণত হলো। বাবা মা তো বটেই, দাদু-দিদু থেকে
শুরু করে সবাইকে সে তার “কাই কাই” এর ভক্ত বানিয়ে ছাড়লো।
এরপর সে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আর খাই খাই এর কথা ভুলছে একটু একটু
করে। তার জায়গায় এসে স্থান নিচ্ছে “আজি ধানের ক্ষেতে”
কিংবা “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে”। এমনকি স্কুলের
প্রোগ্রামে গাওয়া জাপানী “সাকুরা”ও আছে তার মাঝে।
এরই মাঝে বাসায় আরেকজন নতুন অতিথি এসেছে –
রিয়ান। ছোট ভাইটিকে দেখে রাখার ব্যপারে জীশানের উৎসাহের অন্ত নেই। আট বছরের জীশান
আর এক বছরের রিয়ান সুন্দর খেলে দুজনে মিলে – অবশ্য তার জন্য
আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে রিয়ানের মেজাজ ভালো থাকতে হবে, না হলে কান্না শুরু করে
দিয়ে তা উচ্চগ্রামে উঠলে আমাদের কাউকে গিয়ে সামলাতে হয়। আজকে দুপুরে দুই ভাইকে
খেলতে দিয়ে আমি একটা কাজ নিয়ে বসেছি ল্যাপটপে – শুনি পাশের ঘর থেকে
রিয়ানের কান্নার শব্দ বাড়ছে। ব্যপারখানা দেখতে উঠবো –
ঠিক এই সময়ে ভোজবাজির মত কান্নার শব্দ থেমে গেলো আর তার জায়গায় ভেসে এলো পরিচিত
সুরে গাওয়া সেই ছড়াটা – “খাই খাই করো কেন এসো বোসো আহারে”। বড়টা গানের সুরে
গাইছে ছড়াটা আর কান্না থামিয়ে ছোটটা মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে! আমি ওঠা বাদ দিয়ে
আবার বসে পড়লাম ল্যাপটপে আর আবারও মনে মনে একটা স্যালুট ঠুকলাম প্রিয় সুকুমার
রায় ওরফে সুকুদাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন