রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

দেশ বিদেশের রূপকথা - থাইল্যান্ড

এক সময় এক দেশে ছিল দুই বন্ধু। তারা ছিল খুবই দরিদ্র, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাদের দেশেও খুব একটা কাজ ছিল না। ফলে যদিও তারা বেশ পরিশ্রমী ছিল, কিন্তু তবুও তারা সবসময় কাজ পেত না। অল্প যে সময় তারা কাজ পেত, মন দিয়ে সে কাজ করত। তাতে করে তারা ভালো পারিশ্রমিকও পেত। কিন্তু যেহেতু সবসময় কাজ থাকতো না, তাই তাদের উপার্জন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেত। আবার কায়ক্লেশে চলতো তাদের দিন। এভাবে বছরের পর বছর চলে যায়, তাদের অবস্থার পরিবর্তন আর হয় না।

শেষ মেষ তারা খুব বিরক্ত হয়ে ঠিক করলো তারা শ্যাম দেশে চলে যাবে। বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বনাম ছিল শ্যাম। তারা শুনেছিল শ্যাম দেশটা খুব ভালো দেশ ওখানে প্রচুর কাজ পাওয়া যায় আর ওখানকার লোকজনও খুব সুখে শান্তিতে থাকে। যেই ভাবা সেই কাজ - তারা নৌকা করে চলে এলো শ্যাম দেশে।

আরেব্বাসরে শ্যাম দেশটা কী সুন্দর!! যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। আর লোকজনকে দেখেই বোঝা যায় তারা ভীষন সুখী। দুই বন্ধু শ্যাম দেশে নেমে তো ভারী খুশী। তারা আরো বেশী খুশি হয়ে গেলো যখন প্রথম দিন নেমে নেমেই তারা কাজ পেয়ে গেলো। কঠোর পরিশ্রম করে সুষ্ঠু ভাবে সে কাজ সম্পাদন করায় তাদের উপার্জনও হলো বেশ ভালো।

সেদিন রাতে দুই বন্ধু তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে বসেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই হোক, তারা প্রত্যেকে এক লাখ বাথ করে জমাবে। বাথ হলো শ্যাম দেশের মুদ্রা। আর যতদিন না তারা এক লাখ বাথ জমাতে পারছে, ততদিন তারা হাঁসের মাংস খাবে না। মানে, কোনরকম বিলাসিতার ধারে কাছ দিয়েও যাবে না।

পরদিন তারা দুজনে চলে গেলো শহরের দুই প্রান্তে। প্রথম বন্ধু খুঁজে পেতে একটা ছোট কাজ জোগাড় করে নিয়ে তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে কাজ করে যা উপার্জন করে, তার বেশীরভাগটাই জমানোর চেষ্টা করে। তার প্রতিদিনে আহার ছিল অল্প একটু ভাত, নোনতা শালগম আর লবণ। হাঁসের মাংস তো দূরের কথা, বাজারে সস্তায় যে ছোট মাছ পাওয়া যেত, সেদিকেও সে ফিরে তাকাতো না। তার একমাত্র চিন্তা ছিল কী করে এক লাখ বাথ জমাবে। তার সবসময় মনে পড়তো বন্ধুর কাছে করা প্রতিজ্ঞা, আর ওমনি সে আরো পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা পেয়ে যেত।

এই ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পরে প্রথম বন্ধুর হাতে কিছু বাথ জমলো। তাই দিয়ে সে ছোটখাট একটা ব্যবসা শুরু করলো। সততা আর অধ্যবসায়ের সাথে ব্যবসা করায় তার ছোট পুঁজি ফুলে ফেঁপে উঠতে বেশীদিন সময় নিলো না। কিন্তু হাতে বেশ কিছু বাথ জমলেও এখনো তার সেই নোনতা শালগম আর ভাত খাবার রূটিনের কোন পরিবর্তন হলো না। বরং সে আরো বেশী করে তার ব্যবসাতে মন দিলো, আর নিজেকে বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিলো তার বন্ধুর কাছে করা প্রতিজ্ঞা। ফলে তার ব্যবসা যেমন বাড়তে থাকলো, তার হাতে টাকা-পয়সাও জমতে থাকলো।

এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর দেখা গেলো তার অনেক ধন সম্পদ হয়ে গেছে। এক লাখ বাথের থেকেও বেশী হয়ে গেছে তার সঞ্চয়। তখন সে একটা সুন্দর দেখে বাড়ি কিনলো। দাস-দাসী রাখলো। আর এবার সে একটু একটু করে হাঁসের মাংস কেনা শুরু করলো।

ওদিকে দ্বিতীয় বন্ধুও শহরের অন্য প্রান্তে একটা ছোট কাজ পেয়েছিল। সেও শুরু করলো কাজ করা। কিন্তু প্রথম দিন কাজ শেষে ফেরার পথে পথের ধারে মোটাসোটা একটা হাঁস বিক্রি হতে দেখে সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, কিনে ফেললো। নিজেকে বললো এই শেষ, আর কিনবো না, শেষ বারের মতো কিনলাম। রাতে খুব মজা করে সেই হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেল।

পরের দিন কাজে যাবার সময় দ্বিতীয় বন্ধু নিজেকে মনে করিয়ে দিলো আজ কিন্তু আর হাঁসের মাংস কিনবো না। কিন্তু কাজ করতে করতে বারে বারে তার মনে হচ্ছিল গতকাল রাতের কথা হাঁসের মাংসটা কী সুস্বাদুই না ছিল! ওই খাবারের কথা চিন্তা করে তার কাজেও ভালো মতো মন বসছিল না। কোন রকমে কাজ শেষ করে সে আবার বাজারে গেলো। ভাবলো আজ মরা হাঁস কিনি। জ্যান্ত হাঁসের চেয়ে নিশ্চয়ই মরা হাঁসের দাম কম হবে। কিন্তু গোটা বাজার খুঁজেও সে কোথাও মরা হাঁস পেলো না। তখন বাধ্য হয়ে (!) সে একটা জ্যান্ত হাঁসই কিনে এনে মজা করে খেলো।

এইভাবে দ্বিতীয় বন্ধুর দিন যেতে থাকলো। সে প্রতিদিনই নিজের কাছে বলতো আজই শেষ, কিন্তু সেই শেষ দিনটা আবার পরের দিনে পাল্টে যেতে থাকলো। প্রতিজ্ঞা একবার ভাংলে তা বারবারই ভাংতে থাকে। সে হাঁস ছাড়াও মুরগী, গরু, শুয়োর - সবই খাওয়া শুরু করলো। ফলে তার হাতে আর বাথ জমে না। সে যা উপার্জন করে, সবই চলে যায় খাওয়ার পিছনে। কয়েক বছর পরেও তার কোন উন্নতি হলো না, শ্যাম দেশে আসার সময় সে যেমন দরিদ্র ছিল, তেমনই রয়ে গেলো।

যখন বেশ কয়েক বছর পরেও তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না, সে ভাবলো যাই, আমার বন্ধুটা কেমন আছে দেখে আসি। এই ভেবে সে চললো শহরের অন্যপ্রান্তে। সেখানে গিয়ে সে যাকেই তার বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করে, সেই তাকে একটা খুব সুন্দর বাড়ি দেখিয়ে দেয়। সে তো খুব অবাক এত সুন্দর আমার বন্ধুর বাড়ি! তার বিশ্বাস হতে চায় না। শেষে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর সে সাহসে ভর করে ঢুকলো সেই বাড়িতে।

প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে দেখেই বুঝতে পেরেছে তার অবস্থা। বন্ধুর পরনের মলিন পোশাক আর তার জীর্ণ চেহারা দেখেই সে আন্দাজ করেছে। কিন্তু কিছু বুঝতে না দিয়ে প্রথম বন্ধু তাকে হাসিমুখে স্বাগত জানালো। নরম গলায় বললো এসো, তুমি থাকো আমার সাথে। এই বলে সে তার বাড়ির পেছনের একটা ঘর খুলে দিলো বন্ধুকে থাকতে।
খাওয়ার সময় হলে সে তার বন্ধুর জন্য পাঠালো ভাত, শালগম আর লবন। সেই সাথে তাকে দেখিয়ে দিলো একটা তেঁতুল গাছ। বললো খাওয়ার সময় এই গাছের অল্প কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিও তুমি, সেদ্ধ করে লবন আর ভাতের সাথে খেতে ভালো লাগবে।

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই গাছটির সব পাতা শেষ করে ফেললো দ্বিতীয় বন্ধু। তারপর সে আরেকটি গাছের পাতা ব্যবহারের অনুমতি চাইতে গেলো বন্ধুর কাছে। শুনে মুচকি হাসলো তার বন্ধু। বললো দেখো, গাছটার পাতা বেশী বেশী করে খেয়ে সব পাতা শেষ করে ফেলেছো তুমি। যদি তা না করে ছোট ডালটা থেকে অল্প করে পাতা নিতে, তাহলে তোমার বড় ডালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ছোট ডালে আবার পাতা গজিয়ে যেত। তুমি নিজে নিজের উপরেও ঠিক এই কাজটিই করেছ। যখন তোমার বাথ জমানোর কথা তখন তুমি বিলাসিতার পেছনে তা উড়িয়ে দিয়েছ। ভবিষ্যতের কথা না ভেবে তুমি মজা করে হাঁসের মাংস খেয়েছ। তার ফলেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে।


এই শুনে দ্বিতীয় বন্ধুর খুব অনুতাপ হলো। সে এর পর থেকে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি মিতব্যয় করা শুরু করলো। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই তার হাতে কিছু বাথ জমে গেলো। তখন প্রথম বন্ধু তাকে ব্যবসা করা শেখালো। নিজের সঞ্চয় করা পুঁজি আর বন্ধুর পরামর্শ মত ব্যবসা করে সেও কয়েক বছরের মধ্যে একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললো।

রে ব্র্যাডবেরীর উদ্ধৃতি, বই পড়ার অভ্যাস ও আমার চিন্তার খোরাক

ফেসবুকে আজ এক নেটাতো বন্ধু ( যার লেখার আমি একজন বড় ভক্তও) দেখি অন্যতম প্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক রে ব্র্যাডবেরীর একটা কথা উদ্ধৃতি দিয়েছে। কথাটা হলো

You don t have to burn books to destroy a culture. Just get people to stop reading them
পড়ে কিছুক্ষণ থমকে থাকলাম। আমার ভেতরে ভীষন রকম নাড়া দিয়ে গেলো কথাটা। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথাটা তো যারপরনাই সত্য! এখন পড়ার বইয়ের পাশাপাশি কতজন পড়ছেন গল্পের বই? বই নিত্যসঙ্গী কয়জনের? একুশে বইমেলা বাদ দিলে সারা বছর জুড়ে কতজন বই কিনছেন? সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, পরিসংখ্যান করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি সংখ্যাটা খুব বেশী নয়। আরো ভয়ানক কথা হচ্ছে - এই সংখ্যাটা সম্ভবত দিন দিন কমছে!

কেন বলছি? বলছি কয়েকটা অভিজ্ঞতা আর পরিদর্শন থেকে। বর্তমানে ফেসবুক ও অন্তর্জালের যুগে অনেক বেশী বই পড়ুয়ার সাথে পরিচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বইয়ের রিভিউও পাচ্ছি অনেক বেশী। আর ই-বুকের তো কথাই নেই এখন বাংলা ই-বুকও পাচ্ছি অজস্র। তারপরও কেন আমার এই হতাশাবাদী কথা? আমি তো আশাবাদীই হতে চাই, কিন্তু আশেপাশের নমুনা দেখে আশা করার আশাটাও যে করতে পারছি না!

বছর দশেক আগেকার কথা। আমি মাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলের বাস ধরে ফিরে যাই আমার পদ্মা পাড়ের শহরে ছুটির দুটো দিন ওখানে কাটিয়ে সংগ্রহ করে আনি পরের পাঁচ দিনের জীবন সংগ্রামের রসদ। অবধারিত ভাবে অফিস থেকে বের হয়ে আগে একটা-দুটো বই কিনি, ফেরার পথ কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যায় টের পাই না। বাড়ি ফেরার টানের সাথে বইয়েরও একটা প্রধান ভূমিকা থাকে এতে।

অফিস থেকে বাস স্ট্যান্ড এই পথের মধ্যেই দুই তিনটা বইয়ের দোকান পড়ত, বই কিনতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি তাই। বিশেষ করে পথের মাঝে কিছুটা দূরে দূরে দুটো বাস স্টপে ছিল দুটো বইয়ের দোকান যারা আমার বিশেষ প্রিয় ছিল। আর আমার নিজের ছোট্ট শহরটাতে তো এখানে ওখানে বইয়ের দোকান ছিল সমবায় সুপার মার্কেট নামে একটা মার্কেটই ছিল বইয়ের দোকানে ভর্তি।

এরপর চাকরীর সুবাদে ঘোরাঘুরি দেশের উত্তর প্রান্তের শহরগুলোতে। ওখানে অবস্থানের দিনগুলিতে বই কিনতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। একটা কারণ চাকরীর ধরণ সময় খুব বেশী পাওয়া যেত না। আরেকটা কারণ নতুন শহরের আনাচে কানাচে সেভাবে হয়তো খোঁজ নিতে পারি নি। তাই বই কিনতে প্রায়ই পুরো শহর পাড়ি দিয়ে অন্যপ্রান্তে যেতে হতো। যখন বইয়ের খোঁজে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা যেতাম, মনের ভেতরে একটা কষ্ট গুমরে উঠতো রাস্তার পাশে একটু দূর পর পর মোবাইলের দোকান, ফাস্ট ফুডের দোকান দেখে। রাজধানী থেকে এত দূরেও ব্যাঙের ছাতার মত ফাস্ট ফুড বা মোবাইলের এটা ওটার দোকান গজিয়ে উঠতে তো কোন অসুবিধে হয়নি, কয়েকটা বইয়ের দোকান হতে কী ক্ষতি ছিল? নিজেকে স্বান্ত্বনা দিতাম - ছোট শহর তো, তার উপরে দেশের দরিদ্রতম এলাকার একটা- এখানে বইয়ের দোকান সেভাবে এখনি তো হবে না, তবে হবে নিশ্চয়ই, হবে অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে।

এরপর আবার বছর কয়েকের জন্য ফিরে এলাম আমার আশৈশব প্রিয় শহরে। কিন্তু মন গহনে বয়ে চলা দুঃখের সেই চোরাস্রোত থামলো না! এত্তগুলো বইয়ের দোকান ছিল, এখন আছে মাত্র গুটি কয়েক! কোথায় সমবায় মার্কেটের সারি সারি দোকান গুলো? সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে সরে গেছে, জায়গা ছেড়ে দিয়ে গেছে স্টেশনারী আর জেনারেল স্টোরকে! প্যাপিরাস, সূচীপত্র আর গ্রন্থমেলার জায়গা নিয়েছে মেসার্স হালিম ট্রেডার্স আর জেনারেল পেপার স্টোর। একপাশে তাও একটা বই বাজার আছে, আছে ঐতিহ্যবাহী আলিগড় লাইব্রেরীও, কিন্তু তারা স্নাতক-স্নাতকত্তোর শ্রেণির বই ছাড়া অন্য কোন বই রাখে না। এদের পাশে টিমটিম করে হাতে গোনা গুটিকয় দোকান এখনো আছে, কিন্তু তারা মনে হচ্ছে ডাইনোসরের প্রজাতি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই তাদের হিমশিম খাবার অবস্থা! অথচ মোবাইলের যন্ত্রপাতি আর ফাস্ট ফুডের দোকানের রমরমা অবস্থা এখানেও। রীতিমতো দুই-তিনটা আলাদা বাজারই বসে গেছে এদের জন্য!
এরপর আমার পুনরাগমন রাজধানী শহরে। থানা গাড়লাম শহরের উত্তরপ্রান্তের একটা এলাকায়। হয়তো রাজধানীর সাথে খুব একটা চেনা জানা নেই বলেই আশে পাশে কোথায় বইয়ের দোকান আছে খুঁজে পাই না, যাও দুয়েকটা পাই, তারা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের বই আর খুব বেশী হলে স্নাতক শ্রেনির কিছু বই রাখে, তাও জনপ্রিয় কিছু বিষয় যেমন কম্পিউটার, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসায় প্রশাসন ইত্যাদির। অগত্যা আবার সেই নীলক্ষেতের দ্বারস্থ হতে হলো।
কিন্তু তিলোত্তমা ঢাকা নগরীর এমাথা থেকে ওমাথা যাওয়ার চেয়ে
বড় বালাই আর নাই। তাই বাধ্য হয়ে মাসে এক-দুবার যাই, একেবার একগাদা করে বই কিনে ফিরে আসি। আর পথের ধারে মোবাইলের ছোট ছোট দোকানগুলো দেখে কষ্টের চোরাস্রোতটা তিরতির করে কাঁপন তোলে বুকের মাঝে।

আসা যাওয়ার পথের ধার থেকে খুব বেশী দূরে নয় আমার বছর দশেক আগেকার সেই সাপ্তাহিক পথটা। একদিন গেছিলাম পুরাতন সেই দুই বইয়ের দোকানের খোঁজে। নিয়মিত বই কেনার সুবাদে কয়েকজনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল, তাদের সাথে আবার দেখা করার একটা সুপ্ত বাসনাও ছিল মনের মাঝে। কিন্তু ওখানে গিয়ে আবারও হোঁচট খেলাম বইয়ের দোকানদুটো উঠে গেছে! আর সেখানে বসেছে মোবাইলের একটা দোকান আর একটা কনফেকশনারী!


বইয়ের দোকানের এভাবে ক্রমশ লোপপ্রাপ্তির পেছনে কারণ কি এটাই যে আমরা ক্রমশ বই বিমুখ হয়ে পড়ছি? ঢাকায় চলাফেরার সময়ে বাসে কিংবা বিভিন্ন সময়ে চায়ের দোকানে প্রচুর কিশোর-তরুনকে দেখি। মোবাইলে কথা বলার পাশাপাশি এরা গেমস বা ফেসবুক ইত্যাদি ব্যবহার করে। শুধু কৌতুহল বশত প্রায় জনা পনেরো জনকে প্রশ্ন করে জেনেছি এরা কেউ মোবাইলকে ই-বুক রিডার হিসেবে ব্যবহার করে না। বেশীরভাগ তো কিনডলের নামই শোনেনি, যদিও রেইল রাশ বা টেম্পল রান পরিচিত সবার কাছেই। আমার এই ছোট্ট কৌতুহলী প্রশ্ন অবশ্যই বর্তমানকে কোন ক্রমেই সর্বোতভাবে প্রতিফলিত করে না। কিন্তু আমার নিজের কাছেই এই প্রশ্নটা বার বার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা আগেও খুব একটা বইপ্রেমী বা পড়ুয়া জাতি ছিলাম না। যেটুকু ছিলাম, এখন কি তাও হারিয়ে যেতে বসেছে? আজ রে ব্র্যাডবেরীর কথাটা পড়ার পরে মনে হচ্ছে পাকিস্তানীরা ভয়াল ছোবল হেনে আমাদের যে জায়গাটায় চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিল কিন্তু একেবারে ধ্বংস করতে পারেনি, আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেই জায়গাটাকে ধ্বংস করার উৎসবে মেতেছি?

গ্রীক পুরাণের উপাখ্যান - ইউরোপা অপহরণ

ভূমধ্যসাগরের তীরে সুজলা সুফলা এক শান্তিপূর্ণ রাজ্য ফিনিশিয়া। সেখানে রাজত্ব করেন রাজা এজিনর। রাজা এজিনর আর রাণী টেলেফাসার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। দুই ছেলে ক্যাডামাস আর সিলিক্স (যার নামানুসারে পরে সিসিলিয়া দ্বীপের নাম রাখা হয়েছে)। আর একমাত্র মেয়ে রাজকন্যা ইউরোপা। (কারো কারো মতে ইউরোপা ছিল রাজা ফিনিক্সের কন্যা, যে ফিনিক্সের নামানুসারে ফিনিশিয়া রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল)। তো যাই হোক, এই রাজকন্যা ইউরোপা ছিল অসামান্যা রূপসী। তার রূপ দেখলে সবাই থ হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুখে আর কথা সরে না। 

এক রাতে স্বপ্ন দেখে ইউরোপার ঘুম ভেঙে গেল। সে স্বপ্নে দেখে দুই মহাদেশ দুই নারীর বেশ ধরে এসে তার উপরে নিজেদের দাবী জানাচ্ছে। একজন হলো এশিয়া মহাদেশ। সে বলে যেহেতু এশিয়ায় জন্ম, তাই ইউরোপার উপরে তার দাবীই যথার্থ। কিন্তু অপর মহাদেশ, যার এখনো কোন নাম নেই, সরবে ঘোষনা করছে জন্মস্থান মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না কারণ দেবরাজ জিউস তার কাছে ইউরোপাকে উপহার দেবেন।

এই রকম স্বপ্নের মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে না পেরে ইউরোপা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। তারপর ভোর হয়ে এসেছে দেখে সখীদেরকে ডেকে ফুল তুলতে গেলো। সাগর পাড়ে রাজা এজিনরের রাজপ্রাসাদ। সুনীল জলরাশি এসে লুটিয়ে পড়ছে বালুকাবেলায়। আর তার পাশেই বিশাল এক বাগান। কত রকমের ফুল সেখানে। গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে আছে রকমারী সব ফুল, মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে অল্প অল্প। আর কী তাদের বাহার। বোধহয় তারই আকর্ষণে ছুটে এসেছে অলির দল, গুঞ্জন তুলেছে এখানে ওখানে। এমন চমৎকার রোদ ঝলমলে ফুটফুটে দিনে বাগানের রাশি রাশি ফুলের মাঝে কোথায় উড়ে গেলো ইউরোপার রাতের স্বপ্ন! ইউরোপা ব্যস্ত হয়ে পড়লো সখীদের সাথে খেলায় আর ফুল তোলায়।

এদিকে হয়েছে কী দেবরাজ জিউস তাঁর অলিম্পাসের প্রাসাদে বসেছিলেন। হঠাৎই তাঁর নজর পড়লো ফিনিশিয়ার সাগর তীরে ইউরোপাদের উচ্ছল দলটির উপরে। ইউরোপার নজরকাড়া সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেলেন তিনি। আর ঠিক ওই সময়েই প্রেমের দেবতা এরস এসে হাজির হলেন জিউসের কাছে। জিউসকে মুগ্ধ নয়নে ইউরোপার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর তাঁর হাতের ধনুক থেকে ছুঁড়লেন একটি পুষ্পশর সোজা জিউসের দিকে। ব্যস, আর যায় কোথা, মুহূর্তেই ইউরোপার প্রেমে পড়ে গেলেন দেবরাজ। এমনিতেই ইউরোপার অনিন্দ্যসুন্দর রূপ আর অপরূপ দেহবল্লরী মুনি ঋষিদেরও ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়, তার উপরে প্রেমের দেবতার শর! দেখতে না দেখতেই জিউস প্রেমাবেগে পাগলপারা হয়ে উঠলেন।

জিউস পত্নী হেরা তখন ব্যস্ত ছিলেন অন্যদিকে। এই সুযোগে জিউস নিজেকে রূপান্তরিত করলেন ধবধবে সাদা একটা ষাঁড়ে। তারপর এসে নামলেন সাগরপাড়ের ফুলবাগানে, যেখানে ইউরোপা ব্যস্ত বান্ধবীদের নিয়ে ফুল তোলায়।
ইউরোপা আর তার বান্ধবীরা তো ষাঁড়টিকে দেখে রীতিমত অবাক! এত সুন্দর যে কোন প্রাণী হতে পারে, তা তাদের ধারণারও বাইরে ছিল। কী ফুটফুটে গায়ের রঙ! ঠিক যেন শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে জ্যোছনা! আর বাগানের সব ফুলের গন্ধ ম্লান হয়ে যায় এর সৌরভে। সুরেলা গলায় মৃদু শব্দ করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ষাঁড়টি। শব্দ তো নয়, মনে হচ্ছে যেন মৃদুমন্দ লয়ে বাজনা বাজছে কোথাও! ষাঁড়টিকে সবাই মিলে ঘিরে ধরলো।

আশ্চর্য! ষাঁড়টি ভয়ও পাচ্ছে না ইউরোপাদেরকে।বরং গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে আরামে সুরেলা শব্দ করছে। আর ইউরোপা যখন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তখন তো ষাঁড়টি রীতিমতো প্রায় একটা গানই গেয়ে ফেললো!

ব্যাপারস্যাপার দেখে ইউরোপার তো খুশী আর ধরে না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে, আর তার তৈরী করা ফুলের মালাগুলো জড়িয়ে দিলো ষাঁড়ের গলায় আর শিঙে। ষাঁড়ও যেন খুশি ইউরোপার আদর পেয়ে। আস্তে করে সামনের পা জোড়া মুড়ে পিঠ নিচু করে দাঁড়ালো। আনন্দে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফ দিয়ে ষাঁড়ের পিঠে উঠে পড়লো ইউরোপা।

যেই না ইউরোপা তার পিঠে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে পিঠ সোজা করে ফেললো সেই ষাঁড়, আর তীর বেগে ছুটলো সাগরের দিকে। হায় হায় করতে করতে ইউরোপার সখীরা ছুটলো ষাঁড়ের পিছু পিছু। কিন্তু তারা তো সাধারণ মানবী। হোক না উচ্চবংশীয়, মানুষ তো। পারবে কেন ষাঁড়রূপী দেবরাজের সাথে? দেখতে না দেখতে ষাঁড়টি ইউরোপাকে পিঠে নিয়ে নেমে পড়লো সমুদ্রে। আর সখীরা সাগরের তীরে বসে আকুল নয়নে কাঁদতে থাকলো।

ষাঁড়ের পিঠে বসে ইউরোপা দেখছে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় ফিনিশিয়ার তটরেখা তাকে নিয়ে ষাঁড়টি দ্রুতবেগে সাঁতরে চলেছে গভীর থেকে আরো গভীর সমুদ্রে। আর তাদের আশেপাশে রীতিমতো মিছিল তৈরী করে ফেলেছে বিভিন্ন জীব জন্তু আর দেবতার দল। ডলফিনের পিঠে চেপে এসেছে নারিয়ার্ডসরা, চক্কর দিচ্ছে তাদেরকে ঘিরে। সমুদ্রদেব পসাইডনের ছেলে ট্রাইটনকে দেখা যাচ্ছে মহানন্দে তার শঙ্খ বাজাচ্ছে। আরে ওইতো, সমুদ্র দেবতা পসাইডন নিজেও আছেন দেখা যাচ্ছে!

ইউরোপার আর বুঝতে বাকি নেই যে এই ষাঁড়টি একটি ছদ্মবেশী দেবতা। সে করুণ সুরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো দেবতার কাছে যেন তাকে ছেড়ে দেয়া হয়, তাকে তার দেশে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হয়। জিউস তখন ইউরোপাকে জানালেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। ইউরোপার প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রণয়ের কথা সবিস্তারে বললেন।

এরপর জিউস ইউরোপাকে নিয়ে এলেন ক্রীট দ্বীপে। সেই ক্রীট দ্বীপ যেখানে জিউস নিজে জন্মেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। ডিক্টে গুহা যেখানে জিউস জন্মগ্রহণ করেন, রূপ নেয় জিউস আর ইউরোপার প্রেমকুঞ্জে। এখানেই ইউরোপার গর্ভে জিউসের তিন পুত্র সন্তান হয়। এদের মধ্যে মিনোস পরে ক্রীট দ্বীপের রাজা হয়েছিলেন এবং বিখ্যাত মিনোয়ান বংশের সূচনা করেছিলেন।

জিউস ইউরোপার প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ ইউরোপাকে তিনটি উপহার দেন। প্রথম উপহার ছিল টালোস নামে ব্রোঞ্জের তৈরী একটি সৈনিক, যে ক্রীট দ্বীপের পাহারাদার ছিল। দ্বিতীয় উপহারটি ছিল একটি অদ্ভুত সুন্দর ও দক্ষ শিকারী কুকুর যার নাম লাইয়েল্যাপস। আর তৃতীয় ও শেষ উপহারটি ছিল একটি বর্শা যা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়না।
কথিত আছে যে ক্রীট দ্বীপের গোরটিন ছিল ইউরোপা আর জিউসের প্রথম মিলনস্থল। তাঁরা মিলিত হয়েছিলেন একটা সাধারণ গাছের নীচে। পরে জিউসের আশীর্বাদে এই সাধারণ গাছটি পরিনত হয় একটি চির-হরিৎ বৃক্ষে। আর যে ষাঁড়ের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন জিউস, তাকে অমর করে রাখা হয় তারকামন্ডলীতে স্থান দিয়ে। বৃষ রাশিই হচ্ছে সেই তারকামন্ডল।

ইউরোপার অপহরণের কাহিনি আজো লোকের মুখে মুখে ফেরে। তাইতো ইউরোপা অপহরণের এই কাহিনি নিয়ে চিত্রকর্মের পাশাপাশি ২ ইউরো মানের গ্রিক মুদ্রায় খোদিত হয় ষাঁড়রূপী জিউস কর্তৃক ইউরোপা অপহরণের দৃশ্য। আর ইউরোপ মহাদেশের নামকরণ করা হয় ইউরোপা থেকেই যেমনটি ইউরোপার স্বপ্নে ছিলো।

সুকুমার রায় ও একটি ঘুম পাড়ানী গান

প্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের এক ছড়া সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রিয় ছড়াকারদের নিয়ে বলেছিলেন আমার প্রিয় দুই সুকুমার, বড়ুয়া ও রায়/ তাদেরই নাম আগে লিখি প্রিয়র তালিকায়। দুই সুকুমার আমারও খুব প্রিয়। বিশেষত সুকুমার রায় যে সবচেয়ে প্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার নেয়া নিকটাই বোধহয় এর সবচেয়ে বড় নমুনা। আজকের লেখাটা সুকুমার রায়কে নিয়েই, তবে লেখাটা হয়ত হতো না যদি না আজকের ঘটনাটা ঘটতো। ঘটনাটা যথাসময়ে বলবো, তার আগে সংক্ষিপ্ত পূর্বকথাটা বলে নিই।

সুকুমার রায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার আব্বু। আমি বোধহয় তখন ক্লাস টু-এ পড়ি। নতুন ক্লাসের নতুন বই হাতে পেয়ে যথারীতি উল্টেপাল্টে দেখছি আর নতুন বইয়ের গন্ধ নিচ্ছি (কী যে ভালো লাগতো নতুন বইয়ের গন্ধ! এখনও লাগে)। বাংলা বইটা হাতে নিয়ে দেখছি, আব্বু বললেন সুকুমার রায়ের ছড়াটা পড়ো। সেই প্রথম পড়া দাদা গো দেখেছি ভেবে অনেকদূর---। যদিও এর পরের লাইনেই হোঁচট খেলাম আগের লাইনের সাথে কোন মিল নেই দেখে (মিল ছাড়াও কবিতা হয় এই ধারণাটা তখনো হয়নি)। কিন্তু তারপরও প্রবল এক আকর্ষনে টেনে নিয়ে গেলো ছড়াটা। পড়তে থাকলাম –“এই দুনিয়ায় সকল ভালো/আসল ভালো নকল ভালো--- অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে ছড়াটা ভালোলাগার এক আবেশময় দুনিয়ায় দুলিয়ে চলছিল আমাকে। তারপর এলো সেই বিশেষ মুহূর্ত- চমকে উঠলাম শেষ লাইনটা পড়ে পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়! এইভাবে যে প্রথম লাইনের সাথে শেষ লাইনটা মিলিয়ে দেয়া যায়, শৈশবের শুরুতেই মুগ্ধ বিস্ময়ে তা আবিস্কার করা সুকুমারের হাত ধরে। ছড়াটা পড়তে এতটাই ভালো লেগেছিল যে ঐ রাতেই ছড়াটা আমার মুখস্ত হয়ে গেছিল। এর পরের কটা দিন বাড়ির লোক তো বাড়ির লোক, গোটা পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করে ছেড়েছিলাম যখন তখন ছড়াটা শুনিয়ে।

সেই শুরু। তারপর যেখানেই পাই, সুকুমার গিলি। রকম সকম দেখে কয়েক বছর পর আব্বু আমাকে সুকুমার সমগ্র কিনে দিলেন। আমার তো মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম!! এর পরের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পাঠকের ধৈর্য্যের আর পরীক্ষা নেবো না আমার মনে হয় সুকুমার নিয়ে বা সুকুমার সমগ্র নিয়ে সবার অভিজ্ঞতাই মোটামুটি একই রকম। শুধু এইটুকু বলি কালের গর্ভে আমার অনেক বই ই মার্ক টোয়েনীয় কায়দায় মালিকানা বদল করেছে, কিন্তু ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ে পাওয়া সুকুমার সমগ্র এখনও সগর্বে আমার বইয়ের তাকের উপরের অংশ দখল করে রেখেছে।

এর পরের ঘটনা প্রায় দেড় যুগ পরের। আমার বড় ছেলের বয়স তখন দেড় বছর। রাতের বেলা ঘুমোতে চায় না, ট্যাঁ ট্যাঁ করে সারা পাড়া জাগিয়ে রাখে। আমি ওকে বুকে চেপে এ ঘর ও ঘর করি আর গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করি। সময় লাগে অনেক। পরিচিত ঘুম পাড়ানি গানগুলোও এত ছোট যে বারবার একই গান গাইতে বিরক্ত লাগে। অগত্যা বড় বড় ছড়াগুলো ওকে গানের সুরে গেয়ে শোনানো শুরু করলাম। এখানেও দেখি সুকুমারের জয়জয়কার। দুই বিঘা জমি, দেবতার গ্রাস কিংবা বিদ্রোহীর চেয়ে খাই খাই সুর করে গাওয়া অনেক সহজ আর আকর্ষনীয়!! সুতরাং ধন ধান্য পুষ্প ভরা আর খাই খাই করো কেন হয়ে উঠলো জীশানের ঘুম পাড়ানি গান। ফলাফল হলো ভারি মজার একটু বড় হয়ে দেখি সে আপন মনে মাঝে মাঝে গাচ্ছে কাই কাই কলো কেন এতো বোতো আহালে

ব্যস, আরেকটা মজা শুরু হয়ে গেলো। ওর আধো আধো বোলে কাই কাই পারিবারিক বিনোদনে পরিণত হলো। বাবা মা তো বটেই, দাদু-দিদু থেকে শুরু করে সবাইকে সে তার কাই কাই এর ভক্ত বানিয়ে ছাড়লো।
এরপর সে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আর খাই খাই এর কথা ভুলছে একটু একটু করে। তার জায়গায় এসে স্থান নিচ্ছে আজি ধানের ক্ষেতে কিংবা মেঘের কোলে রোদ হেসেছে। এমনকি স্কুলের প্রোগ্রামে গাওয়া জাপানী সাকুরাও আছে তার মাঝে।


এরই মাঝে বাসায় আরেকজন নতুন অতিথি এসেছে রিয়ান। ছোট ভাইটিকে দেখে রাখার ব্যপারে জীশানের উৎসাহের অন্ত নেই। আট বছরের জীশান আর এক বছরের রিয়ান সুন্দর খেলে দুজনে মিলে অবশ্য তার জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে রিয়ানের মেজাজ ভালো থাকতে হবে, না হলে কান্না শুরু করে দিয়ে তা উচ্চগ্রামে উঠলে আমাদের কাউকে গিয়ে সামলাতে হয়। আজকে দুপুরে দুই ভাইকে খেলতে দিয়ে আমি একটা কাজ নিয়ে বসেছি ল্যাপটপে শুনি পাশের ঘর থেকে রিয়ানের কান্নার শব্দ বাড়ছে। ব্যপারখানা দেখতে উঠবো ঠিক এই সময়ে ভোজবাজির মত কান্নার শব্দ থেমে গেলো আর তার জায়গায় ভেসে এলো পরিচিত সুরে গাওয়া সেই ছড়াটা খাই খাই করো কেন এসো বোসো আহারে। বড়টা গানের সুরে গাইছে ছড়াটা আর কান্না থামিয়ে ছোটটা মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে! আমি ওঠা বাদ দিয়ে আবার বসে পড়লাম ল্যাপটপে আর আবারও মনে মনে একটা স্যালুট ঠুকলাম প্রিয় সুকুমার রায় ওরফে সুকুদাকে।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

সেবা প্রকাশনীর সেকাল ও একাল – একজন পাঠকের চোখে

আমি জানিনা সেবা প্রকাশনীর ইদানীং কী হয়েছে – বর্তমানে অনুবাদের মান তলানীতে এসে ঠেকেছে। গত মাস পর্যন্ত (সী হক, অনুবাদ সম্ভবত সায়েম সোলায়মান) প্রকাশিত সেবার সবকয়টি অনুবাদ আমি পড়েছি। কিন্ত বিগত দুই/তিন বছরের অনুবাদগুলো আমাকে সন্তষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি শেষ ভালো অনুবাদ (সেবা প্রকাশনীর) পড়েছি বোধহয় “মন্টেজুমার মেয়ে”। এর পরের কোন অনুবাদই মনে দাগ কাটতে পারেনি। ছেলেবেলায় পড়া তিন মাস্কেটিয়ার, কালো তীর, রবিনহুড, আইভানহো কিংবা সাগরতলে বা আশি দিনে বিশ্বভ্রমণের সেই আবেদন এখনকার কোন অনুবাদে পাই না। এটা কি বড় হয়ে যাওয়ার ফল? না মনে হয়, কারণ মন্টেজুমার মেয়ে (অনুবাদ কাজী আনোয়ার হোসেন) তো আগের মতই লেগেছে। একটা কারণ কি অনুবাদক পরিবর্তন হয়ে যাওয়া? হতে পারে, কারণ কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, শেখ আবদুল হাকিম, রওশন জামিল, শওকত হোসেন কিংবা নিয়াজ মোর্শেদের সেই জাদুকরী ভাষা আসলেই এখনকার সায়েম সোলায়মান, টিপু কিবরিয়া কিংবা কাজী মায়মূর হোসেনের লেখায় পাই না, পাই না সেবার প্রতিষ্ঠা করা সহজিয়া মনকাড়া সেই ভাষাশৈলী।
শুধু অনুবাদই নয়, এ কথা প্রযোজ্য কম-বেশী সেবার সব বইয়ের ক্ষেত্রেই। সাম্প্রতিককালের মাসুদ রানা পড়ে আগের সেই অনুভূতিগুলি ফিরে আসে না। অগ্নিপুরুষ পড়ে চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা দুই ফোঁটা অশ্রু, কিংবা রডরিকের সাথে গলামিলিয়ে “আই লাভ ইউ, ম্যান” বলতে গিয়ে আবিষ্কার করা গলা বুঁজে গেছে অথবা দ্বারোকার কামানে বোমা বাঁধার পর টের পাওয়া যে এতক্ষন দম আটকে রেখেছিলাম – কই, নতুন বইগুলোর একটারও ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনা কেন?
আলেয়ার পিছেতে যে এরফান জেসাপের সাথে পরিচয়, ডেথ সিটি বা আবার এরফানের পাতায় পাতায় যার দুর্ধর্ষতার নিয়ত প্রমাণ, সেই এরফান যেন কোথায় হারিয়ে গেল – অ্যারিজোনায় এরফান বা পরের বইগুলিতে তাকে আর সেইভাবে পেলাম না। টান টান কাহিনি আর পাতায় পাতায় উত্তেজনায় ভরা সেই ওয়েস্টার্নের কোন টানই যেন পাই না এখন। আগেকার হুয়ান কর্টেজ ওরফে সাবাডিয়া, সাডেন শেভলিন, ড্যান ও’হারা প্রভৃতি চরিত্রদের পাশে এখনকার চরিত্রগুলো বড়ই পানসে।
সবচেয়ে হাস্যকর পরিবর্তন বোধহয় হয়েছে তিন গোয়েন্দায়। সাইকেল চালিয়ে বেড়ানো দুরন্ত কৈশোরের প্রতীক সেই তিন গোয়েন্দা নাকি এখন ভূত ঠেকাতে আর ভিন-গ্রহবাসীদের নিয়ে ব্যস্ত!
আর উপন্যাস বা গল্প সংকলনের কথা তো বলাই বাহুল্য। আত্মহত্যা, বন্দিনী, হলো না রত্না, বিদেশযাত্রা, পঞ্চরোমাঞ্চ, ছয়রোমাঞ্চ, ছায়া অরণ্য, অষ্ট আতংকের মত বই তো দূরের কথা, গুন্ডা বা শোধ নেবে? এর মতও বই পেলাম না বহুদিন। বলতে ইচ্ছে করে – মাথাই নেই তার আবার মাথাব্যথা!
প্রায় তিন দশক ধরে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা এবং জীবন, ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া সেবা প্রকাশনীর বর্তমান হালে আমি বড়ই মর্মাহত।
-১৮/০৭/২০১২ 

শৈশব ও কৈশোরের সেই দিনগুলি বনাম আমার ছেলে

ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠ ঘাট পেরিয়ে অজানা এলাকায় হাজির হওয়া বা একদল ছেলে মিলে সময় পেলেই পদ্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া বা উজানে যাওয়া বালিবাহী নৌকা ধরে কিছুদুর গিয়ে আবার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে আসা কিংবা শীতের সকালে গাছ থেকে সদ্য পাড়া খেজুরের রস খাওয়ার জন্য গ্লাস হাতে ভাইবোনদের সাথে লাইন দেয়া অথবা ঝড়ের মধ্যে মায়ের বারণ না শুনে আম কুড়োতে দৌড় – যাওয়া বা আসার পথে পাড়ার ছেলেরা মিলে দলবেঁধে বৃষ্টিতে ভেজা কিংবা কখনো কখনো কাদার মধ্যে ফুটবল খেলা যেখানে খেলার চেয়ে গড়াগড়ি খাওয়াটাই বেশী হতো – ছেলেবেলার এই স্মৃতিগুলো এখনও মনের মনিকোঠায় এতই উজ্বল অক্ষরে লেখা যে, যে কোন মুহূর্তে চাইলেই এদের আদ্যোপান্ত জ্বলজ্বল করে ওঠে। মনে হয় এইতো সেদিন বন্ধুদের সাথে বাজিধরে ক্যান্টনমেন্টের গাছের আম চুরি করতে গেছি, এক আর্মি দেখে ফেলায় এক দৌড়ে প্রাচীর পার হয়ে পাশের পুকুরে লাফ দিয়ে পড়েছি (ভাগ্যিশ সেই ব্যাটাও আমার পিছু পিছু প্রাচীর টপকাতে আসেনি) কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারীর ভোরে সবাই মিলে আশে পাশের বাড়ী থেকে (যাদের ফুলগাছ ছিল) ফুল চেয়ে নিয়ে শহীদ মিনারে অর্পণ করে এসেছি – এরকম আরো কত স্মৃতি!!
মনে পড়ে শৈশব বা কৈশোরে স্কুলের গরমের ছুটির দিন গুলোতে বাড়িতে থাকতাম শুধু খাওয়ার সময়ে। মা-বাবারও ছেলেকে নিয়ে অত চিন্তা ছিলনা, সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরলেই চলত। আর একটু বড় হওয়ার পর তো সারাদিন মেতে থাকতাম ফুটবল নয়তো ক্রিকেট খেলা নিয়ে। সন্ধ্যার পরে অবশ্য পড়তে বসতে হতো – তাও রাত ন’টা পর্যন্ত।
স্মৃতির ডানায় ভর করে সেই স্বপ্নময় দিন গুলোয় ফিরে গেলে এই সব সোনালী ছবিগুলোই ভাসে মনের আয়নায়। আমার ছেলেকে (বয়স সাত বছর) যখন আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাই, ওর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখি। ওকে লুকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি – কারণ ইচ্ছে করলেও এরকম শৈশব ওকে দিতে পারছি না! দেব কি, সারাদিন তো ওকে বাসাতেই আটকে রাখি। খেলতে দেবো, মাঠ কোথায় এই ইঁট-কাঠ-পাথরে ঢাকা ঢাকা শহরে? যাও বা আছে, নিরাপত্তাহীনতায় ওকে একা পাঠানোর কথা ভাবতেও পারি না। আমি যে নিয়ে যাবো- অফিস থেকে বের হয়ে যানজট পার হয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বাজে রাত আটটা!! তাই বেচারা মাঠের অভাবে ব্যালকনিতে দৌড়াদৌড়ি করে। কখনো কখনো কোন পার্কে বা খোলা জায়গায় নিয়ে গেলে ওর আর আনন্দের সীমা থাকেনা! আর সেটা দেখে আমার ভেতরের কষ্টটা বাড়ে আরো – ওকে তো প্রতিদিন এই সুযোগটা দিতে পারছি না!
আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটা অনেকটা “ফার্মের মুরগীর” মত বড় হচ্ছে। প্রতিদিন দেখি, আর অক্ষম একটা আক্রোশে নিজেই গুমরে মরি – এ রকম একটা শৈশব কি ওর পাওনা ছিল?
-১৯/০৭/২০১২