এক সময়
এক দেশে ছিল দুই বন্ধু। তারা ছিল খুবই দরিদ্র, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়
অবস্থা। তাদের দেশেও খুব একটা কাজ ছিল না। ফলে যদিও তারা বেশ পরিশ্রমী ছিল, কিন্তু
তবুও তারা সবসময় কাজ পেত না। অল্প যে সময় তারা কাজ পেত, মন দিয়ে সে কাজ করত।
তাতে করে তারা ভালো পারিশ্রমিকও পেত। কিন্তু যেহেতু সবসময় কাজ থাকতো না, তাই
তাদের উপার্জন খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেত। আবার কায়ক্লেশে চলতো তাদের দিন। এভাবে
বছরের পর বছর চলে যায়, তাদের অবস্থার পরিবর্তন আর হয় না।
শেষ মেষ
তারা খুব বিরক্ত হয়ে ঠিক করলো তারা শ্যাম দেশে চলে যাবে। বর্তমান থাইল্যান্ডের
পূর্বনাম ছিল শ্যাম। তারা শুনেছিল শ্যাম দেশটা খুব ভালো দেশ –
ওখানে প্রচুর কাজ পাওয়া যায় আর ওখানকার লোকজনও খুব সুখে শান্তিতে থাকে। যেই ভাবা
সেই কাজ - তারা নৌকা করে চলে এলো শ্যাম দেশে।
আরেব্বাসরে
– শ্যাম দেশটা কী সুন্দর!! যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। আর
লোকজনকে দেখেই বোঝা যায় তারা ভীষন সুখী। দুই বন্ধু শ্যাম দেশে নেমে তো ভারী খুশী।
তারা আরো বেশী খুশি হয়ে গেলো যখন প্রথম দিন নেমে নেমেই তারা কাজ পেয়ে গেলো। কঠোর
পরিশ্রম করে সুষ্ঠু ভাবে সে কাজ সম্পাদন করায় তাদের উপার্জনও হলো বেশ ভালো।
সেদিন
রাতে দুই বন্ধু তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে বসেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই
হোক, তারা প্রত্যেকে এক লাখ বাথ করে জমাবে। বাথ হলো শ্যাম দেশের মুদ্রা। আর যতদিন
না তারা এক লাখ বাথ জমাতে পারছে, ততদিন তারা হাঁসের মাংস খাবে না। মানে, কোনরকম
বিলাসিতার ধারে কাছ দিয়েও যাবে না।
পরদিন
তারা দুজনে চলে গেলো শহরের দুই প্রান্তে। প্রথম বন্ধু খুঁজে পেতে একটা ছোট কাজ
জোগাড় করে নিয়ে তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে কাজ করে যা উপার্জন করে, তার
বেশীরভাগটাই জমানোর চেষ্টা করে। তার প্রতিদিনে আহার ছিল অল্প একটু ভাত, নোনতা
শালগম আর লবণ। হাঁসের মাংস তো দূরের কথা, বাজারে সস্তায় যে ছোট মাছ পাওয়া যেত,
সেদিকেও সে ফিরে তাকাতো না। তার একমাত্র চিন্তা ছিল কী করে এক লাখ বাথ জমাবে। তার
সবসময় মনে পড়তো বন্ধুর কাছে করা প্রতিজ্ঞা, আর ওমনি সে আরো পরিশ্রম করার
অনুপ্রেরণা পেয়ে যেত।
এই ভাবে
কিছুদিন যাওয়ার পরে প্রথম বন্ধুর হাতে কিছু বাথ জমলো। তাই দিয়ে সে ছোটখাট একটা
ব্যবসা শুরু করলো। সততা আর অধ্যবসায়ের সাথে ব্যবসা করায় তার ছোট পুঁজি ফুলে
ফেঁপে উঠতে বেশীদিন সময় নিলো না। কিন্তু হাতে বেশ কিছু বাথ জমলেও এখনো তার সেই
নোনতা শালগম আর ভাত খাবার রূটিনের কোন পরিবর্তন হলো না। বরং সে আরো বেশী করে তার
ব্যবসাতে মন দিলো, আর নিজেকে বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিলো তার বন্ধুর কাছে করা
প্রতিজ্ঞা। ফলে তার ব্যবসা যেমন বাড়তে থাকলো, তার হাতে টাকা-পয়সাও জমতে থাকলো।
এভাবে বেশ
কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর দেখা গেলো তার অনেক ধন সম্পদ হয়ে গেছে। এক লাখ বাথের
থেকেও বেশী হয়ে গেছে তার সঞ্চয়। তখন সে একটা সুন্দর দেখে বাড়ি কিনলো। দাস-দাসী
রাখলো। আর এবার সে একটু একটু করে হাঁসের মাংস কেনা শুরু করলো।
ওদিকে
দ্বিতীয় বন্ধুও শহরের অন্য প্রান্তে একটা ছোট কাজ পেয়েছিল। সেও শুরু করলো কাজ
করা। কিন্তু প্রথম দিন কাজ শেষে ফেরার পথে পথের ধারে মোটাসোটা একটা হাঁস বিক্রি
হতে দেখে সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, কিনে ফেললো। নিজেকে বললো এই শেষ, আর
কিনবো না, শেষ বারের মতো কিনলাম। রাতে খুব মজা করে সেই হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেল।
পরের দিন
কাজে যাবার সময় দ্বিতীয় বন্ধু নিজেকে মনে করিয়ে দিলো –
আজ কিন্তু আর হাঁসের মাংস কিনবো না। কিন্তু কাজ করতে করতে বারে বারে তার মনে
হচ্ছিল গতকাল রাতের কথা – হাঁসের মাংসটা কী সুস্বাদুই না ছিল! ওই খাবারের কথা চিন্তা করে
তার কাজেও ভালো মতো মন বসছিল না। কোন রকমে কাজ শেষ করে সে আবার বাজারে গেলো। ভাবলো
আজ মরা হাঁস কিনি। জ্যান্ত হাঁসের চেয়ে নিশ্চয়ই মরা হাঁসের দাম কম হবে। কিন্তু
গোটা বাজার খুঁজেও সে কোথাও মরা হাঁস পেলো না। তখন বাধ্য হয়ে (!) সে একটা জ্যান্ত
হাঁসই কিনে এনে মজা করে খেলো।
এইভাবে
দ্বিতীয় বন্ধুর দিন যেতে থাকলো। সে প্রতিদিনই নিজের কাছে বলতো আজই শেষ, কিন্তু
সেই শেষ দিনটা আবার পরের দিনে পাল্টে যেতে থাকলো। প্রতিজ্ঞা একবার ভাংলে তা
বারবারই ভাংতে থাকে। সে হাঁস ছাড়াও মুরগী, গরু, শুয়োর - সবই খাওয়া শুরু করলো।
ফলে তার হাতে আর বাথ জমে না। সে যা উপার্জন করে, সবই চলে যায় খাওয়ার পিছনে।
কয়েক বছর পরেও তার কোন উন্নতি হলো না, শ্যাম দেশে আসার সময় সে যেমন দরিদ্র ছিল,
তেমনই রয়ে গেলো।
যখন বেশ
কয়েক বছর পরেও তার অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না, সে ভাবলো যাই, আমার বন্ধুটা কেমন
আছে দেখে আসি। এই ভেবে সে চললো শহরের অন্যপ্রান্তে। সেখানে গিয়ে সে যাকেই তার
বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করে, সেই তাকে একটা খুব সুন্দর বাড়ি দেখিয়ে দেয়। সে তো খুব
অবাক – এত সুন্দর আমার বন্ধুর বাড়ি! তার বিশ্বাস হতে চায় না। শেষে অনেক
দ্বিধা দ্বন্দ্বের পর সে সাহসে ভর করে ঢুকলো সেই বাড়িতে।
প্রথম
বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে দেখেই বুঝতে পেরেছে তার অবস্থা। বন্ধুর পরনের মলিন পোশাক
আর তার জীর্ণ চেহারা দেখেই সে আন্দাজ করেছে। কিন্তু কিছু বুঝতে না দিয়ে প্রথম
বন্ধু তাকে হাসিমুখে স্বাগত জানালো। নরম গলায় বললো –
এসো, তুমি থাকো আমার সাথে। এই বলে সে তার বাড়ির পেছনের একটা ঘর খুলে দিলো বন্ধুকে
থাকতে।
খাওয়ার
সময় হলে সে তার বন্ধুর জন্য পাঠালো ভাত, শালগম আর লবন। সেই সাথে তাকে দেখিয়ে
দিলো একটা তেঁতুল গাছ। বললো খাওয়ার সময় এই গাছের অল্প কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিও
তুমি, সেদ্ধ করে লবন আর ভাতের সাথে খেতে ভালো লাগবে।
কিন্তু
কয়েকদিনের মধ্যেই গাছটির সব পাতা শেষ করে ফেললো দ্বিতীয় বন্ধু। তারপর সে আরেকটি
গাছের পাতা ব্যবহারের অনুমতি চাইতে গেলো বন্ধুর কাছে। শুনে মুচকি হাসলো তার বন্ধু।
বললো দেখো, গাছটার পাতা বেশী বেশী করে খেয়ে সব পাতা শেষ করে ফেলেছো তুমি। যদি তা
না করে ছোট ডালটা থেকে অল্প করে পাতা নিতে, তাহলে তোমার বড় ডালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে
ছোট ডালে আবার পাতা গজিয়ে যেত। তুমি নিজে নিজের উপরেও ঠিক এই কাজটিই করেছ। যখন
তোমার বাথ জমানোর কথা তখন তুমি বিলাসিতার পেছনে তা উড়িয়ে দিয়েছ। ভবিষ্যতের কথা না
ভেবে তুমি মজা করে হাঁসের মাংস খেয়েছ। তার ফলেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে।
এই শুনে
দ্বিতীয় বন্ধুর খুব অনুতাপ হলো। সে এর পর থেকে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি মিতব্যয়
করা শুরু করলো। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই তার হাতে কিছু বাথ জমে গেলো। তখন প্রথম
বন্ধু তাকে ব্যবসা করা শেখালো। নিজের সঞ্চয় করা পুঁজি আর বন্ধুর পরামর্শ মত
ব্যবসা করে সেও কয়েক বছরের মধ্যে একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
করে ফেললো।